তুমি কি কখনো ভেবেছো, নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নির্জন বটবৃক্ষের কথা, যে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে, অথচ তার ছায়ায় কত শত ক্লান্ত পথিক আশ্রয় পায়? আহমেদ ছফা ছিলেন তেমনি এক বটবৃক্ষ।



আজকের এই দিনেই অর্থাৎ ৩০ ই জুন, ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের এক অনন্য প্রতিভা আহমেদ ছফা। তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক, এক সাহসী চিন্তাবিদ, মানবিক বুদ্ধিজীবী এবং অন্তহীনভাবে দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এক যোদ্ধা। 

ছফার শৈশব আর্থিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে। কিন্তু তার ভেতরের আগুন, অদম্য জেদ আর সৃষ্টিশীল কৌতূহল তাকে বারবার এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, সেই নিঃসঙ্গতার ভেতরেই তৈরি করেছিলেন বিশাল এক সৃষ্টিশীল ভুবন।

তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে মানুষের অন্তর্জগতের টানাপোড়েন, সমাজের বৈষম্য, মিথ্যা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী প্রতিবাদ। ‘গাভী বিত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বর’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ — এইসব বই শুধু সাহিত্যের সম্পদ নয়, বরং আমাদের চিন্তার বিকাশের একেকটি জ্ঞানভান্ডার৷ 

ছফা ছিলেন এক অচলপত্র মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি কখনোই আপোষ করেননি; না সাহিত্য নিয়ে, না সমাজ নিয়ে, না রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে। তার বন্ধুরা, সহযোদ্ধারা তাকে এক ‘অপার্থিব সন্ন্যাসী’ হিসেবে দেখতেন, যে সব সময় সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ তার সম্পর্কে লিখেনঃ-

আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দল বেঁধে তাঁর পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন “আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশ।” আমরা গভীর মুগ্ধতায় তাঁর আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তাঁর নাম আহমদ ছফা। আমাদের সবার ছফা ভাই।’

তার বইগুলোতে পাঠক খুঁজে পান বাঙালি জাতির আত্মার পরিপূর্ণ প্রতিফলন। তার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধ গ্রন্থে বাঙালি মুসলমান সমাজের জটিল মানসিক গঠন ও আত্মপরিচয়ের সংকট অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়েছে। সাহসিকতা ও স্পষ্টভাষীতা তাকে আলাদা করে দিয়েছে তার সমকালীন লেখকদের থেকে।

ছফা ছিলেন প্রেমের কবি, কিন্তু সেই প্রেমে ছিল বেদনার ছাপ, ছিল এক নিঃসঙ্গ মানুষের দীর্ঘশ্বাস। তার জীবনযাপনে ছিল না কোনো চাকচিক্য বা বাহুল্য। গাঁটের পয়সা ফুরিয়েও তিনি বই কিনতেন, ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতেন, বিপদে পড়া মানুষের জন্য ছুটে যেতেন।

কিন্তু তার লেখা, তার জীবনদর্শন, তার লড়াই আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

আজ আহমেদ ছফার জন্মদিনে আমরা তার কাছে ঋণস্বীকার করি। আজ আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই সেই বোহেমিয়ান আত্মার প্রতি, যিনি আমাদের শিখিয়েছেন — লেখক কেবল কলমে সীমাবদ্ধ নয়, সে সমাজের বিবেক, মানুষের বন্ধু, আর প্রতিরোধের প্রহরী।

জন্মদিনে আহমেদ ছফাকে জানাই বিনম্র প্রণতি। তার অমর বাণী আমাদের ভাবনার জগতকে আরও প্রসারিত করুক, আমাদের কলমকে আরও তীক্ষ্ণ করুক।

শ্রদ্ধাঞ্জলি, আহমেদ ছফা। জন্মদিনে ভালোবাসা।