সবুজে মোড়া পৃথিবীর পথে হেঁটে যাওয়া এক নিরহংকার সাধক ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭-তে তিনি চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু রেখে গেছেন প্রকৃৃতি-সাহিত্যের অগণিত আলোকরেখা। প্রকৃতিকে তিনি শুধু পড়াশোনার বিষয় করেননি, করেছেন জীবনের অনিবার্য কবিতা।
জীবন বৃৃত্তান্ত
ব্যক্তিগত জীবন
২৯ মে, ১৯২৯ সালে সিলেট বিভাগের ( সাবেক বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত ) মৌলভীবাজার জেলার বরলেখা উপজেলার একটি গ্রাম শিমুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন দ্বিজেন শর্মা। তাঁর পিতা ছিলেন চন্দ্রকান্দ শর্মা, একজন "কবিরাজ" (গ্রাম্য হারবাল চিকিৎসা), মাতা মগ্নময়ী দেবী, বিবি দেবী শর্মা।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
কবি দ্বিজেন শর্মা বিএসসি (অনার্স) সম্পন্ন করেন সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে, এবং এমএসসি (বোটানি) সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৫৮ সালে।
চাকরি ও শিক্ষাদান
• ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল।
• নটরডেম কলেজ, ঢাকা (উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ) (১৯৬২ থেকে ১৯৭৪)
পরবর্তীতে তিনি মস্কোতে যান এবং Progress Publishers-এ অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। ২০০০ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং Asiatic Society of Bangladesh-এর সাথে কাজ শুরু করেন, বিশেষত Banglapedia প্রকল্পে জীববিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও অনুবাদক হিসেবে। Asiatic Society-র প্রকাশনা কমিটির দায়িত্বে ছিলেন, এবং বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত নিয়ে ৫৬ খণ্ডের একটি বিগ-এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে।
পুরষ্কার ও স্বীকৃৃতি
- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার - ১৯৮৭
- একুশে পদক - ২০১৫
- ড. কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক - ১৯৮৬
- এম নুরুল কাদের শিশু-সাহিত্য পুরস্কার - ২০০০
- প্রকৃতি সংরক্ষণ পদক - ২০১১
সাহিত্য, প্রকৃৃতি ও বৈশিষ্ট্য
দ্বিজেন শর্মা ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক। প্রাকৃতিক পরিবেশ, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতন লেখা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
তার লেখাগুলোতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন-জঙ্গল, উদ্ভিদ ও ফুল-ফল-পরিবেশের বিবরণ খুবই শিল্পময়ভাবে পাওয়া যায়।
তিনি সাহিত্য ও অনুবাদ কাজও করেছেন, বিশেষত প্রকৃতি ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ক বই-পুস্তক অনুবাদ ও রচনা।
চিন্তা-দর্শন ও সাহিত্য স্টাইল
ভাষা সহজ, স্থির ও অনুভবময়; বিজ্ঞান ও প্রকৃতির বিবরণ হলেও সাহিত্যিক রস রয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ককে সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর লেখায় ব্যতিক্রমীভাবে অনুভব ও বিশ্লেষণ মিলেছে, যেমন সমাজতন্ত্র, রাষ্ট্রের ভূমিকা, মানুষের দায় ও অধিকার নিয়ে ধারণা। জনসাধারণ ও বিশেষ-গ্রুপ (ছাত্র, প্রকৃৃতিপ্রেমী, শিক্ষাবিদ)-এর মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে প্রচেষ্টা; শুধু লিখে নয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও প্রকৃতি রক্ষা বিষয়ে কাজ।
সাহিত্য ও প্রকৃতি-সংক্রান্ত অবদান
১. প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া
দ্বিজেন শর্মা ছিলেন একজন প্রাকৃতিক জগত ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, কিন্তু তিনি শুধু বিজ্ঞানীর মতো নয়, সাহিত্যিকভাবেও লিখেছেন — যাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ পাঠকরা প্রকৃতিকে ভালোভাবে অনুভব করতে পারে। ভবিষ্যতের পরিবেশ সচেতন নাগরিক গঠনে তাঁর বই-লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
২. বিজ্ঞান ও পরিবেশের প্রতি মানবিক যোগাযোগ গঠন
তাঁর লেখায় বিজ্ঞান ও প্রকৃতির তথ্য কিন্তু শুধু তথ্য হিসাবে নয়, অনুভব ও দার্শনিকভাবে উপস্থাপন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কীভাবে ফুল কথা বলে, বৃক্ষের ছায়া, জীবজন্তু ও মানুষ-প্রকৃতি সম্পর্ক — এসব বিষয়গুলোতে তিনি সংবেদনশীল হয়েছেন।
৩. সমাজ ও ভাববাদ বিষয়ক চিন্তা
শুধু প্রকৃতি-বিজ্ঞান নয়, তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়েও চর্চা করেছেন। যেমন, "সমাজতন্ত্রে বসবাস" (Living in Socialism) নামক গ্রন্থে সমাজতন্ত্রের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এইভাবে তিনি বিজ্ঞান ও সমাজের সংযোগ দেখতে পেতেন ও পাঠককে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতেন যে, প্রকৃতি এবং সমাজ কখনও আলাদা বিষয় নয়।
৪. অনুবাদ কাজ
সোভিয়েত সময়কাল থেকে অনুবাদ কাজ করেছেন, যা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অপরিহার্য সাহিত্য ও বৈজ্ঞানিক লেখা সহজলভ্য করেছে। অনুবাদ ছাড়াও, শিশুসাহিত্য ও নতুন প্রজন্মের জন্য লেখা-প্রবন্ধ ছিল তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৫. শিক্ষক ও জনসাধারণে প্রভাব
শিক্ষকের ভূমিকায় তিনি বহু শিক্ষার্থীকে উৎসাহ দিয়েছেন প্রকৃতি এবং বিজ্ঞান বিষয়ে। নটরডেম কলেজ-এ পড়ানো, ব্রজমোহন কলেজ-এ কাজ, এবং পরবর্তীতে লেখক ও প্রকৃতি বিষয়ক গবেষক ও সম্পাদক হিসেবে কাজের মাধ্যমে শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছেন। তার “ট্রি-লগ” বা বৃক্ষরোপণ, উদ্ভিদবিচারণ, পার্ক-বাগান সৃষ্টি ইত্যাদিই তাঁর প্রকৃতি-ভ্রমণ ও কর্মের অংশ।
৬. রাস্তার/নগর জীবনে ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রকৃতির অনুভব
ঢাকার পার্ক, রাস্তা, সাধারণ পরিবেশে বৃক্ষ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ, প্রকৃতি প্রেম বৃদ্ধির জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭-তে তিনি চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন সবুজ পৃথিবীর প্রতি এক অমলিন ভালোবাসা, রেখে গেছেন প্রকৃতি-বিজ্ঞানকে সহজ ও সাহিত্যিক ভাষায় ছুঁয়ে যাওয়ার বিরল উদাহরণ। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন— ফুল কথা বলে, গাছ গল্প শোনায়, বনভূমি কেবল কাঠের ভাণ্ডার নয়, বরং জীবনের কবিতার অনন্ত পঙ্ক্তি। “শ্যামলী নিসর্গ”, “গহন কোন বনের ধারে”, “ফুলগুলো যেন কথা” কিংবা “জীবনের শেষ নেই”— প্রতিটি বই প্রকৃতি ও জীবনের দার্শনিক ব্যাখ্যা হয়ে উঠেছে।বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান শুধু পরিবেশচর্চায় সীমাবদ্ধ নয়; তিনি সমাজতন্ত্র, বিজ্ঞানশিক্ষা ও মানবিক দায়িত্ব নিয়েও লিখেছেন। তার প্রতিটি শব্দ যেন আমাদের আহ্বান জানায়— প্রকৃতিকে ভালোবাসো, কারণ প্রকৃতিই জীবনের প্রথম ও শেষ কবিতা।
লেখাঃ হালিমা আক্তার মেঘলা
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
0 মন্তব্যসমূহ